অন্তিম পর্বঃ চন্দ্রতাল
একটা পৌরাণিক গপ্পো শুনুন।
সে অনেক অনেককাল আগেকার কথা। সূর্যদেবের এক পুত্র ছিলো, নাম ভাগা। কি বলছেন ? সূর্যদেবের ছেলে বলে তো মনু, যম, কর্ণ এদেরকেই জানি। আরে বাবা, এর বাইরেও এদিক-সেদিক আরো অনেকে ছিলো। যাই হোক, সূর্যদেবের এক ছেলের নাম ছিলো ভাগা। আর চন্দ্রদেবের এক মেয়ে ছিলো, তার নাম – বুঝেই ফেলেছেন – চন্দ্রা। ছিলো তো ছিলো, এরা বেশ নিজের মনে ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছিলো। একদা এই দুটি তরুণ-তরুণীর দেখা হলো বারা-লাচ-লা তে। বারা-লাচ-লা কি? সেটি একটি পার্বত্য গিরিপথ, লাদাখের দিকে যেতে পড়ে। তখনকার দিনে যেরকম হতো আর কি – চারি চক্ষের মিলন হবামাত্র দ্যুলোক-ভূলোক কেঁপে উঠলো, আকাশে-বাতাসে বাঁশি আর বেহালা বেজে উঠলো আর দুজনে ওমনি একে ওপরের প্রেমে পড়ে গেল। আসলে তখন তো ছেলে-মেয়েদের এরকম ফ্রি-মিক্সিং সমাজ ছিলো না, যাকে দেখে তারই প্রেমে পড়ে যেত আর কি।

এই সেই বারা-লাচ-লা। এবার আমরা যাই নি। মনিদীপার তোলা দু বছরের পুরোনো ছবি
ঠিক বলিউডের সিনেমার মতো – দূই বাপ প্রবল আপত্তি করে বসলেন। এতো বড়ো আস্পদ্দা – ইহারা লভ করিতে চায় ? স্বয়ং পছন্দ করিয়া বিবাহ করিতে চায়? হারগিজ নেহি। এদিকে চন্দ্রদেব আর সূর্যদেব ব্যক্তিগত জীবনে যে কেচ্ছার ফোয়ারা ছুটিয়েছেন, তার বেলায় যেন কোন দোষই নেই। ওই তো, চন্দ্রদেব – তিনি তো বৃহস্পতি মুনির বৌ তারাকে ফুসলিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন তো ৪৯৭ ধারাটি বাতিল হয়ে যায় নি – বৃহস্পতি সোজা দেবতাদের কাছে কমপ্লেন করেছিলেন। তারপর তারাদেবী তো ফিরলেন, কিন্তু তখন তিনি গর্ভবতী। সে নিয়েও মেলা লাফড়া হয়েছিলো – জারজ পুত্রের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে। আর এদিকে সূর্যদেব, তার তো আবার কুন্তীর সঙ্গে কেলেঙ্কারি – যা থেকে কর্ণের জন্ম হয়। সে সবে দোষ নেই, কিন্তু ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিক নিয়মে বিয়ে করতে চেয়েছে, ওমনি দুজনে একদম কাদের-খান-অমরীশ-পুরী হয়ে উঠলেন। অজুহাত দিলেন যে সূর্যদেবের ইচ্ছে তার ছেলে জগতে আলো ছড়াবে আর চন্দ্রদেবের ইচ্ছে তার মেয়ে রাতের আকাশে তারা জ্বালবে। যেহেতু এক আকাশে চন্দ্র-সূর্য ওঠে না, তাই তাদের বিয়ে সম্ভব নয়। এইসব ছেঁদো অজুহাত দিয়ে নিজেদের ইগো আর ব্যক্তিগত অ্যাম্বিশনের সামনে একদম ‘কুরবান’ করে দিলেন তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে।
তবে সেযুগের ছেলে-পিলেরাও এযুগের মতোই তালেবর – অতো সহজে ‘কুরবান’ হবার পাত্রই নয় তারা। চন্দ্রা আর ভাগা ঠিক করলো তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে। তা পালিয়ে যাবে কোথায় ? বাঃ, সেটাও বলতে হবে – ওই বারা-লাচ-লা তে, যেখানে ওদের চারচক্ষুর মিলন হয়েছিলো! প্ল্যান একদম পাক্কা, দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। মেয়েরা তো একটু বেশী পাংচুয়াল হয়, তাই চন্দ্রা ঠিক সময়মতো বারা-লাচ-লা পৌঁছে গিয়েছিলো। গিয়ে দেখে ভাগার কোন পাত্তা নেই। ভাগা শেষমুহূর্তে ঘাবড়ে গিয়ে ভাগলবা হয়ে গেলো কিনা তার সরোজমিনে তদন্ত করতে বেরোলো চন্দ্রা। হাঁটতে লাগলো কুনজুম লা-র দিকে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে যখন আর শরীর চলছে না, তখন চন্দ্রা এসে পৌঁছলো একটি ঘননীল, কাকচক্ষু হ্রদের ধারে। সেখানে দুদণ্ড জিরিয়ে আবার হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় চন্দ্রা পৌঁছলো তান্ডি নামক একটা জায়গায়। সেখানে গিয়ে দেখে ভাগা হনহন করে উল্টো দিক থেকে আসছে – এতক্ষণে বাবুর খেয়াল হয়েছে যে তার বিয়ে। ভাগ্যিস তখনো তাদের বিয়ে হয় নি, তখনো “প্রেমে-বিভোর” স্টেজ চলছে – তাই ভাগার গালে হাই-হিল স্যান্ডেলের বাড়ি পড়ে নি, বরং একটি সুমধুর “কি-যে-করো-না-তুমি” হাসি তার কপালে জুটেছিলো। ব্যাস – আর কি – দুজনের বিবাহ হলো ওই তান্ডিতেই, স্বর্গ থেকে দিগবধূরা পুষ্পবৃষ্টি করলেন, শুভশঙ্খধ্বনি আর নন্দী-ভৃঙ্গীর সিটির আওয়াজে তিনভুবন মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। এদের দুজনের মিলিত নাম হলো চন্দ্রভাগা।

তান্ডি। এবার আমরা যাই নি। মনিদীপার তোলা দু বছরের পুরোনো ছবি

সুরজ তাল। এবার আমরা যাই নি। মনিদীপার তোলা দু বছরের পুরোনো ছবি
সেই জন্যেই বলা হয় ভাগা নদীর উৎস সুরজতালে, চন্দ্রা নদীর উৎস বারা-লাচ-লার কাছের এক হিমবাহতে – যেখান থেকে সে এক অন্তঃসলিলা নদী হয়ে আসে চন্দ্রতালে, সেই সুনীলহ্রদ যেখানে সে দুদন্ড জিরিয়েছিল। তারপর চন্দ্রতাল থেকে সে নদীরূপে যায় স্পিতি উপত্যকা চিরে, এবং ভাগা নদীর সঙ্গে তান্ডিতে মিলিত হয়ে চন্দ্রভাগা নামে বয়ে চললো সিন্ধুর এক শাখানদী হিসেবে। অনেকে আবার এই চন্দ্রতাল থেকে ট্রেক করে বারা-লাচ-লা যায় – যে পথে একদিন চন্দ্রা এসেছিলো ভাগাকে খুঁজতে, যে পথে সে অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে চলেছে।
সেই চন্দ্রতাল হ্রদ দেখতে আমরা চলেছি।
কাজা থেকে চন্দ্রতাল যাবার একটা নতুন রাস্তা হয়েছে। এটা যায় কিব্বের হয়ে চিচাম হয়ে। কিব্বের মনে আছে তো ? যেখানে আমরা কাজা থেকে গিয়েছিলাম – পাহাড়ের মাথায় – কমিক গ্রামটি তৈরি হবার আগে এটাই এশিয়ার উচ্চতম গ্রাম ছিলো। সেই কিব্বের গ্রামের মধ্যে দিয়ে অতি সরু গলিপথ – যা কারুর বাড়ির উঠোন তো আরকারুর বাড়ির পেছনের দেয়াল ঘেঁষে যায় – সেই ধরে যেতে যেতে পৌঁছলাম একটা ১০০০ ফুট গভীর খাড়াই খাদের সামনে। যার বহু নিচে – প্রায় দেখাই যায় দূরে বয়ে চলেছে সাম্বা-লাম্বা নালা (সত্যিই এই নাম, আমি বানাই নি) আর ওপর একটা একদম নতুন ঝাঁ-তকতকে ব্রিজ। এই ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে গেলেই চিচাম তাই এই ব্রিজের নাম চিচাম ব্রিজ। চিচাম ব্রিজটা এই একবছর হলো খুলেছে, তার আগে নাকি একটা হাতে টানা রোপওয়ে ছিলো, যাতে একজন করে লোক একটি ঝুড়ির মতো জিনিসে চড়ে নিজে নিজে দড়ি টেনে এদিক থেকে ওদিকে যেতো। যারা যেতো, তাদের কলিজাটা কি জিনিস দিয়ে তৈরি ভাবতে ভাবতে এই এশিয়ার উচ্চতম ব্রিজটা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম চিচাম।

চিচামের সেই ব্রিজ
চিচাম থেকে হানসা – যাবার পথে একটা নাম-না-জানা অপূর্ব সুন্দর জায়গায় থামলাম। রাস্তার দুপাশে খয়েরি ঢেউপাহাড়, দূরে নীলদিগন্তে বরফিলা পাহাড়ের সাদা ম্যাজিক আর রাস্তার মাঝখানে একটি নিঃসঙ্গ চরটেন। একেবারে নিঃসঙ্গ নয়, যাত্রীরা এর আশেপাশে পাথরের ছোট ছোট ঢিপি বানিয়ে গেছে। শুনেছি অনেকবছর আগে, যখন এইসব পথ হেঁটে লোকে পেরোতো এবং প্রায়শই পথ হারিয়ে বেঘোরে মরতো, তখন যাত্রীরা কোন দুর্গম জায়গায় পৌঁছতে পারলে সেখানে একটা পাথরের ঢিবি বানিয়ে যেত। শুধু এই জানাতে নয় যে তারা এই দুর্গম জায়গাটিতে পৌঁছতে পেরেছে – ওই পাথরের ঢিবির পাশে কিছু শুকনো খাবার এবং জল রেখে দিয়ে যেতো তারা, পরবর্তী যাত্রীদের জন্যে। সেই রেওয়াজ আজো চলে আসছে – এইসব দুর্গম পয়েন্টে যাত্রীরা একটা করে ছোট ঢিপি বানিয়ে রেখে যায়। খাবার বা জল অবশ্য আর রেখে যায় না।

আমরা – আদি, আমি, অমিত

হানসার আগে সেই নাম না জানা জায়গা।

হানসার আগে সেই নাম না জানা জায়গা।

গিন্নি
হানসা- কিয়োটো পেরিয়ে, লোসার পেরিয়ে সেই কুনজুম পাস। একবার থামলাম, কুনজুম মাতার সামনে মাথা ঠেকালাম আর দুচোখ ভরে দেখলাম দুপাশের ছিটিয়ে পড়ে থাকা সৌন্দর্য। তারপর আবার ছুট-ছুট, নইলে দেরী হয়ে যাবে চন্দ্রতাল পৌঁছতে।

স্পিতি নদী আর তার রঙের বাহার
চন্দ্রতালের কাছে থাকার ব্যবস্থা নেই। থাকতে হয় ক্যাম্প-সাইটে, সেখানে সারি-সারি তাঁবু খাটানো আছে। ক্যাম্পসাইট থেকে দু কিলোমিটার চড়াই বেয়ে গাড়ি করে যেতে হয় চন্দ্রতালের কাছের পার্কিং পয়েন্ট। সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার মতো হেঁটে যেতে হয়। হেঁটে যেতে বয়স্ক লোকেদের একটু কষ্ট হতে পারে, বাকিদের হওয়া উচিৎ নয়। মানে আমাদের মতন আনফিট লোকেরাও তো যেতে পেরেছিলো মশাই। তবে বয়স্ক বা ছোঁড়া, সুস্থ বা খোঁড়া – যাই হোন না কেন, অবশ্যই যাবেন। কষ্ট হলেও যাবেন। সময় থাকলে একবার প্রদক্ষিণও করবেন – প্রায় আড়াই কিলোমিটার হবে, কিন্তু আস্তে আস্তে করলে ঠিক পারবেন। আমরা করতে পারি নি কারণ সময় ছিলো না।
চন্দ্রতাল কেমন, তা কিভাবে বর্ণনা করবো তাই ভাবছি। লিখতে গেলেই সেই লালমোহনবাবু যেমন কি যেন দেখে “অসাধারণ-অনবদ্য-অসামান্য” ইত্যাদি ১১খানা অ দিয়ে বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন, সেইরকম হয়ে যাবে। তার বদলে চাঁচাছোলা গোদা বাংলায় যাক – একটা নিঃসঙ্গ পর্বতমোড়া উপত্যাকা, তার মাঝখানে একটি ঐশ্বরীয় নীল হ্রদ, যে রোদের আলোয় ঝিলকিয়ে উঠছে। হাওয়ায় তার ওপরের জলে খেলে যাচ্ছে একটা হালকা তিরতির, আর তাই মুহূর্তে মুহূর্তে তার রূপ পাল্টে যাচ্ছে। রঙ দেখে মনে হচ্ছে যে কোন এক অতি বাজে ফোটোগ্রাফার ছবিতে একগাদা কালার স্যাচুরেসন করে ফেলে একটা অস্বাভাবিক রঙ করে ফেলেছে – বাস্তবে এরকম রঙ হয়ই না। কটা ছবি দিলাম – দেখুন যদি এর থেকে কিছু অনুভব করতে পারেন।




চন্দ্রতাল থেকে ক্যাম্পসাইটে ফিরলাম তখন বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। আমরা থাকছি প্যারাসল ক্যাম্পে – খুব ভালো ব্যবস্থা। ক্যাম্পে পৌঁছনো মাত্রেই গরম চা আর একরাশ বিস্কুট নিয়ে হাজির তারা। টেন্টের বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল পাতা, সেখানে বসে পা লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে চায়ে চুমুক দিতে যা আনন্দ হলো কি বলবো। তারপর ঢুকলাম আমাদের তাঁবুতে।
হরি হরি – এ তাঁবু নাকি? এতো রীতিমত হোটেলের ঘর! সামনে একটা মালপত্র রাখার খুপরি ঘর, তার পেছনে বিশাল ডবলবেড, পাশে বেডসাইড টেবিল। খাটে বেশ মোলায়েম মোটা গদি, তার ওপর আরো মোটা লেপ। একপাশে টেবিল-চেয়ার। অ্যাট্যাচড বাথরুম – ওয়েসটার্ন স্টাইল উইথ রানিং ওয়াটার! নাথিং তো কমপ্লেন আবাউট, যাকে বলে। এদিকে তাঁবু বলতে তো আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে মাটিতে বিছানা, মোটকা কম্বল বা স্লিপিং ব্যাগ – ওই হেমেন রায়ের “যকের ধন”এ যেরকম ছিলো আর কি।
এখানে তাঁবুতে দেখলাম ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা আছে। বাইরে আছে সোলার প্যানেল, তাতে চলে। রাত নটায় নিভিয়ে দেওয়া হয়। তখন ভরসা ইলেকট্রিক হ্যারিকেন – সেও চার্জ হয় ওই সৌরবিদ্যুতের জোরে। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম একটা জলের ট্যাঙ্ক আছে, ওই সৌরবিদ্যুতে গরম করা জল ধরা থাকে। খাবার আগে বা পরে হাত ধুতে ওই গরমজলটাই ভরসা।
বাইরে বসে বসে দেখতে থাকলাম সামনের পাহাড়ের বরফের সাদা রঙ মরে এলো। নীল আকাশ ক্রমে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠলো, দেখা দিলো চাঁদ – তার রূপোর মতো আলো ঠিকরে পড়লো পাহাড়ের সাদা শিখরে।
না, ভুল বললাম। বাইরে বসে থাকতে পারি নি একটানা। প্রথমে একটা মোটা জ্যাকেট পরে বসেছিলাম, একটু বাদে তাঁবুতে গিয়ে জ্যাকেটের তলায় সোয়েটার পরে এলাম। তারপর ক্রমাগত একটু বাদে বাদে তাঁবুতে যাচ্ছি আর কিছু চাপিয়ে আসছি। একে একে চাপলো থার্মাল ইনার, সয়েটশার্ট, সোয়েটার, জ্যাকেট, টুপি, মাফলার, গ্লাভস। স্ট্রিপটিজের ঠিক উল্টো প্রসেস আর কি। এসব করেও কিছুক্ষণ বাদে আর পারা গেলো না, গুটিগুটি ঢুকে পড়লাম ডাইনিংএর তাঁবুতে। সেখানে বুখারি জ্বলছে, তার ওমে কি আরাম!
সন্ধ্যেটা কাটলো ওই ডাইনিং টেন্টে তাস খেলে, গান শুনে, অতি-সাধরণ-কিন্তু-অসাধারণ-খেতে খাবার খেয়ে, আড্ডা মেরে। শুয়ে পড়েছিলাম তাড়াতাড়ি, তাই ভোরের আলোয় চোখ খুলে দেখতে পেয়েছিলাম চাঁদের আলোয় পাহাড়ের রূপ, তারপর সকালের গোলাপী আভা। অবশ্য এইসব দেখে একটু বেশী উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফেলেছিলাম, একটু বেশী জোরে “আহা আহা” বলেছিলাম বলে বৌয়েরা আমাদের দুই বন্ধুকে অনেক নরমগরম শুনিয়ে দিলেন। তবে আমাদের মনে বোরোলীন লাগানো আছে কিনা, তাই জীবনের এসব ছোটখাটো ওঠাপড়া গায়েই লাগে না।
পরদিন ভোরে উঠে ফেরা।একেবারে ভোরের আলোয় বেরিয়ে পড়লাম। পথে পড়লো সেই সব চেনা জায়গা – ছোটি ধারার ভয়াবহ পাথুরে ঝর্ণা, বাতালে চাচা-চাচির ধাবা তারপর ছত্রু আর তার চন্দ্র ধাবা। সেখানে আলু-পরোটা আর চা সহযোগে উত্তম ব্রেকফাস্ট, তারপর রোটাং হয়ে গোলাবা হয়ে রানী নাল্লা আর তার সামনের মোবাইল ম্যাগি সেন্টার হয়ে, কোঠি পেরিয়ে মানালি দুপুর নাগাদ।
মানালিতে বিশেষ কিছু ঘুরে দেখি নি। যদিও আমাদের কেউ “কিচ্ছু

করবেন না” বলে নি, কিন্তু যাত্রাশেষে মনটা কেমন কাটা-ঘুড়ির মতো উদ্দেশ্যহীন লাগে। মানালির বাজারে টি-শার্ট কিনলাম (সেখানে দেখলাম মহাত্মা-গান্ধী-বব-ডিলান-আভেঞ্জার-তিব্বতী-আর্ট-ভার্লি-আর্ট সবাই পাশাপাশি বিদ্যমান। পাশের রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে দেখা হয়ে গেলো তার মালকিন সেই ইজরায়েলি ভদ্রমহিলার সঙ্গে। ভারী হাসিখুশি, নাম বললেন “কেরান”। বললেন হিব্রুতে “কেরান” আর হিন্দিতে (বা বাংলাতে) “কিরণ” মানে একই – সূর্যালোক।
সূর্যের কিরণের একঝলক হাসি মেখে এযাত্রার নটেগাছটা মুড়োলাম আমরা।
———————————-
উপসংহারঃ
কাল রাত্রে লেখাটা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি ঘরের টেবিলল্যাম্পটা জ্বলছে আর তার সামনে আধাসিলুয়েটে একটা ছায়ামূর্তি। তার চোখে চশমা, ব্যাকব্রাশ করা চুল, আধকপালে টাক। ভদ্রলোক আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন। একসময় ভদ্রলোক কড়া গলায় জিগ্যেস করলেন
“হিমালয় নিয়ে ভ্রমণকাহিনী লিখছো?”
ঘাড় নিচু করে মুখে একটা হেঁহেঁ হাসি ফুটিয়ে তুলেছি সবে, তার আগেই ছায়ামূর্তি আবার প্রশ্ন করলেন
“তুমি একসময় কবিতা লিখতে না?”
“কবিতা? মানে সে তো বহুদিন আগে…”
“বলো তো, প্রবোধের শব্দের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো মিল কোন শব্দের হবে?”
কি বলবো ভাবছি, ছায়ামূর্তি নিজেই উত্তর দিয়ে দিলেন “নির্বোধ। বুঝলে, নির্বোধ। কথাটা মনে রেখো।“
ছায়ামূর্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। দেখলাম খাটের ওপরে “দেবতাত্মা হিমালয়” বইটা পড়ে আছে।