এই ঘরটায় ফজিলুল আগে আসে নি। নাম শুনেছে অবশ্য – “স্টেরিলাইজড লেবার ডিসকাশন রুম”। বেশ গালভরা নাম। বছরখানেক হলো তৈরি হয়েছে ঘরটা – ওই ফ্যাক্টরিটা যখন আবার নতুন করে শুরু হলো, তখন। ঘরটায় গোটা চারেক চেয়ার আছে , চেয়ারের সঙ্গে লাগোয়া সরু একটা করে টেবিল। চেয়ারগুলো সবকটাই কাঁচের দেয়ালটার দিকে মুখ করা।
ফজিলুল একেবারে সামনের চেয়ারটায় বসে কাঁচের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে।
কাঁচের দেয়ালের ওপাশে যিনি আছেন, তাঁকে আবছা দেখা যাচ্ছে – কারণ কাঁচটার রংটা হালকা ধূসর। তবে তিনি পরিচিত ব্যক্তি। তাঁর নাম আভিন্দর সিং। এই ফ্যাক্টরিটার ম্যানেজার। একেবারে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
কাঁচের ঘরের স্পিকারটায় তাঁর গলা গমগম করে উঠলো
“আমি আখরিবার পুছছি তুমাকে – ওই খানার ডিব্বাটা ওখানে কেনো রেখেছিলে?”
“স্যার – আমি তো বললাম – ওটা দীপকের জন্যে। বাড়ি থেকে এনেছিলাম, স্যার।“
“দীপক তো অন্য শিফটে। তুমার সঙ্গে তো উর দেখা হবার কোথা নয়।“
“স্যার, আগে তো আমার শিফটেই ছিল – আমার পাশের মেশিনে। তাছাড়া স্যার, এদ্দিন আমার বাড়ির পাশেই থাকতো। ওই করোনার সময় দাঙ্গা হলো বলে তো ও চলে গেল অন্য পাড়ায়। কিন্তু আমাদের দোস্তি তো খতম হয় নি।“
“এতো দোস্তি হিন্দু আর মুসলমানে, যে অলগ অলগ শিফট – ফির ভি তুমি ওর জন্য খানা নিয়ে আসো। এতো প্যার? নাকি অন্য কোন মতলব?”
“অন্য কী মতলব থাকবে স্যার।“
“এই ধোরো পাশের ওয়ার্কসএর রাধেশ্যামের থেকে টাকা খেয়ে তুমি করোনা বিমারি-ওয়ালা খানা এনে হামাদের ফ্যাক্টরিতে রেখে দিলে। ব্যাস – বিমারি ফ্যল গেলো, আমাদের ফ্যাক্টরিতে ফির সে লকডাউন হোয়ে গেল। ওদের ফায়দা হোয়ে গেলো, তুমার ভি ফায়দা – কিউ? ”
“কী বলছেন স্যার! আমি…আমি”
আভিন্দর সিং কিছু বলবার আগে ফ্যাক্টরি হেলথ এন্ড সেফটির হেড মিঃ মজুমদার বলে উঠলেন
“খাবার থেকে করোনা স্প্রেড করার কিন্তু এভিডেন্স নেই স্যার। গাভমেন্ট থেকেও এরকম ডায়রেক্টিভ নেই।“
স্পিকারটা মিউট করে দিয়ে আভিন্দর সিং মজুমদারের দিকে ঘুরে তাকালেন। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন “বাঙ্গালীবাবু – আপনি বহুত সিধা-সাধা আদমি আছেন। করোনা খানাতে থাকবে কেনো? থাকবে ওই ডাব্বার গায়ে। ওই ডাব্বা ফ্যাক্টরির ফ্রিজে যাবে – তার থেকে আরও লোকেদের ডাব্বায় স্প্রেড করবে। এটা ওই ভজনলালের কোম্পানির চাল হতে পারে। ওই রাধেশ্যাম লোকটাকে আমি খুউব চিনি – এক নম্বরের হারামি আছে।“
“তবুও স্যার – আমার মনে হয় না ফজিলুল এরকম করবে। ওকেও তো আমরা চিনি।”
*****
এনকোয়ারি কমিশনের রিপোর্টটা আসার পর অনেক আলোচনা করে ঠিক করা হলো যে এবারের মতো ফজিলুলকে কড়া ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর ওয়ার্কারদের মধ্যে ডিস্ট্যান্সিংটা আরও বাড়াতে হবে। দুই শিফটের মধ্যে যে একঘণ্টার গ্যাপ আছে, সেটা বাড়িয়ে দেড়ঘণ্টা করে দেওয়া হবে, যাতে কোনভাবেই দুই শিফটের ওয়ার্কারদের দেখাসাক্ষাৎ না হয়। আর প্রতি শিফটের ওয়ার্কারদের মধ্যে দেড় মিটার গ্যাপ মেনটেন হচ্ছে কিনা, সেটা মনিটর করা হবে সার্ভেল্যান্স ড্রোন দিয়ে। ক্যান্টিনেও সার্ভেল্যান্স ড্রোন থাকবে, যাতে ওয়ার্কাররা একে অপরের সঙ্গে আচার বা তরকারি দেওয়া নেওয়া না করে। আভিন্দর সিং এই ব্যাপারটায় বিশেষ করে খুব জোর দিলেন। এদের এই একসঙ্গে, একে অপরকে জড়িয়ে বা বেঁধে রাখার বদঅভ্যাসটি সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।
***
সব শুনে ফতেমা নিজের গালেতে আঙুল ঠেকিয়ে বললো “তোমাদের কোম্পানির পুরো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে চিংড়ি-মাছ দিয়ে পুঁইশাক রান্না হবে আর আমি সেটা আমার রাখিবন্ধের ভাইকে পাঠাতে পারবো না – এমন অজীব কথা বাপের জম্মে শুনি নি!”
প্রথম প্রকাশ ঃ ব্ল্যাকবোর্ড রুদ্র সংখ্যা – ২০২০