“স্যার, এটা কিন্তু একটু রিস্কি ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। ওঁকে এখানে আনার কি দরকার? ওই আগ্রা-টাগ্রাই তো বেশ ছিল – ওখানেই তো সবাই যায়। “ বললেন দিলিপবাবু।
“ওপরমহলের নির্দেশ। তারা তো আমাদের পরামর্শ চায় নি, এবং দিলেও নেবে না। কাজেই…”
“কিন্তু স্যার – ওই আশ্রমের সামনের জায়গাটা কাঁচা মাটির। সেখান দিয়ে ওই মেমসাহেবকে নিয়ে যাওয়াটা… যদি কিছু গোলমাল হয়?”
বড়বাবু হাতের ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর একেবারে মধুক্ষরা কণ্ঠে বললেন “দিলিপবাবু, আমেদাবাদের খাবার খুব ভালো, তাই না?”
“হ্যাঁ স্যার, সে তো বটেই। কিন্তু হঠাৎ…?”
“অনেক ছোট ছোট জিনিসও কি সুন্দর, তাই না? ওই ধরুন রাস্তার ধারে রামভাইয়ের চা আর মস্কাপাও – বিকেলবেলায় খেতে কি ভালই না লাগে, বলুন।“ বড়বাবু আজ খুব মুডে আছেন।
“হ্যাঁ স্যার।“ গদগদকণ্ঠে বললেন দিলিপবাবু।
“তা, এসব ছেড়ে, হঠাৎ যদি আঞ্জারে মরুভূমির মধ্যে আপনার ট্রান্সফার হয়ে যায়, কেমন লাগবে দিলিপবাবু?” বড়বাবুর গলাটা এবার ইস্পাতকঠিন শোনালো। “যদি সেটা না চান, তাহলে ব্যবস্থা করুন ঠিক করে। ওই কাঁচা মাটি ইত্যাদি ছেঁদো অজুহাত দেবেন না প্লিজ।“
দিলিপবাবু ঘর থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন।
***
দুদিন পরের কথা।
এই দুদিনে আশ্রমের সামনের কাঁচা জমিতে পেটাই করে তাকে যথাসাধ্য পোক্ত করে তোলা হয়েছে। দিলিপবাবু আশ্রমের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন, দুরুদুরু বক্ষে। দাঁড়িয়ে আছেন বড়বাবু, মন্ত্রীমশাইরা কজন, তাছাড়া অজস্র সিকিউরিটির লোক। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিমান রাষ্ট্রনায়কের স্ত্রী আসছেন যে ! স্টেট গেস্ট। সঙ্গে থাকবেন বিদেশমন্ত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। রাষ্ট্রনায়ক স্বয়ং আসতে পারেন নি – দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন।
অজস্র গাড়ির কনভয়ের সঙ্গে লম্বা লিমুজিনটা এসে দাঁড়ালো। তার থেকে নামলেন স্টেটগেস্ট সেই ডাকসাইটে সুন্দরী। লাল টকটকে পোশাকটি তাঁকে মানিয়েছে খুব। দিলিপবাবু দেখলেন লাল স্কার্টের তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে মাখন রঙের সুডৌল পা দুটি, আর তাতে শোভা পাচ্ছে স্বর্ণখচিত সুউচ্চ পেন্সিল-হিল।
মনে মনে “দুর্গা” বলে দিলিপবাবু ম্যাডামের সঙ্গে সঙ্গে চললেন।
দেখা গেল ম্যাডাম বিশেষ কিছু পড়াশোনা করে আসেন নি। দিলিপবাবুকে জিগ্যেস করলেন “হি লিভড হিয়ার, ইজ ইট?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম। এইখানেই থেকেছেন দীর্ঘদিন। এইখান থেকেই শুরু করেছিলেন সেই বিখ্যাত ডান্ডি মার্চ। ১৯৩০ সালের ১২ই মার্চ।“
“ডান্ডি মার্চ?“
“ডান্ডি মার্চ। সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স। ব্রিটিশের লবণ ট্যাক্সের বিরোধিতা করে এই সবরমতি আশ্রম থেকে পায়ে হেঁটে ৩৮৫ কিলোমিটার দূরে সুরাটের কাছে ডান্ডি নামক একটি ছোট্ট জায়গায় গেলেন। তারপর ব্রিটিশ সরকারের রক্তচক্ষু অবজ্ঞা করে নুন তৈরি করলেন। অস্ত্রশস্ত্র কিছু ছিলো না ম্যাডাম – হাতে একটা লাঠি, পরনে খাটো ধুতি। আর খালি পা।“
“ইনক্রেডিবল !!“ আর কিছু বলবার আগেই কেলেঙ্কারিটি ঘটলো। সম্রাজ্ঞীর পদযুগলের শোভাবৃদ্ধিকারি ল্যুবুট্যন কোম্পানির স্বর্ণখচিত পেন্সিল-হিলের এক পাটি আচমকা ওই “নেকেড ফকির”এর আশ্রমের সামনের কাঁচামাটিতে সমূলে গেঁথে গেল।
“গেল গেল” করে দৌড়ে এলেন বাকি মন্ত্রীরা, আমলারা, বড়বাবু, মেজবাবু, সেজবাবু।
দিলিপবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
আঞ্জারে ট্রান্সফারটা আর বোধহয় আটকানো গেল না।
***
উত্তরকথনঃ এটি সত্য ঘটনা নয়, তবে প্রায় সত্য। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর স্ত্রীর ভারতভ্রমণের সফরসূচিতে একটি জায়গা ছিল, যেটির সামনের অঞ্চলটি সিমেন্ট বাঁধানো নয়। হাইহিল পরে সেখানে যেতে ম্যাডামের কষ্ট হবে, তাই রাতারাতি সেটা সিমেন্টে বাঁধিয়ে ফেলা হোক – এমন একটা প্রস্তাব উঠেছিল। পরে সেটা বাস্তবায়িত হয় নি।
কেন বাস্তবায়িত হয় নি তার কারণ, বলা বাহুল্য, সরকারি তরফ থেকে জানানো হয় নি। তবে ভাবতে ইচ্ছে করে যে খাটো ধুতি পড়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতেন যে মানুষটি, যিনি সম্ভবত ভারতবর্ষের প্রথম প্রকৃত জননেতা, তাঁর আশ্রমে যাবার রাস্তাটিকে মার্কিন রাষ্ট্রনায়কের স্ত্রীর হাইহিলের জন্যে সিমেন্ট করে দেবার অর্ডারটা দিতে সরকারে কারুর হয়তো, একটিবারের জন্যে হলেও, লজ্জা করেছিল।
প্রথম প্রকাশঃ ফেসবুক – ১৪ জুন, ২০২০